উত্তরাঞ্চলের ইতিহাস-ঐতিহ্য, শিল্প-সাহিত্য, সংস্কৃতির বিকাশ ও উন্নয়নে এবং সর্বোপরি এ অঞ্চলের সাধারণ মানুষের জীবনমান উন্নয়নের লক্ষ্য নিয়ে সদর উপজেলার উত্তম ইউনিয়নে রংপুর দিনাজপুর মহাসড়কের পাশে ১৯৬৭ সালের ১৬ই নভেম্বর রংপুর বেতার কেন্দ্রের যাত্রা শুরু হয়েছিল। ১৯৬৯ এ দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে অস্থিরতা দেখা দেয়। শুরু হয় গণঅভ্যূত্থান। আসে ৭০ এর নির্বাচন। নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নিরংকুশ বিজয় পাক শাসক গোষ্ঠী মেনে নিতে চায় না। শুরু হয় প্রতিবাদ বিক্ষোভ। বাঙ্গালী জাতি আন্দোলনে গর্জে ওঠে। এসময় দেশের অন্যান্য বেতারের মত রংপুরেও ঘোষণায় পরিবর্তন আসে ‘রেডিও পাকিস্তানের’ পরিবর্তে বলা হয় ’রংপুর বেতার কেন্দ্র’। ১৯৭১ এর মহান মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশ বেতার, রংপুর কেন্দ্রের অনেক ক্ষতি সাধিত হয়। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর নতুন উদ্যোমে শুরু হয় বেতারের কার্যক্রম। অনুষ্ঠান প্রচারের সময় বেড়ে যায়, শিল্পী, কলা-কুশলীদের সংখ্যাও বাড়তে থাকে। । উল্লেখ্য, ইতোমধ্যে বেতার কেন্দ্রে নতুন বুলগেরিয়ান ট্রান্সমিটার স্থাপন করা হয়। ফলে প্রচার মান বৃদ্ধি পায়। কিন্তু উত্তমস্থ কেন্দ্রটিতে ট্রান্সমিটারের রেডিয়েশন সমস্যা, শহরের বাহিরে হওয়ায় যাতায়াত ও সময়মত অনুষ্ঠানে উপস্থিতি অনেক ক্ষেত্রে সমস্যার সৃষ্টি হয় । ফলশ্রুতিতে তথ্য মন্ত্রণালয় শহরের কেন্দ্রস্থলে ধাপ ইঞ্জিনিয়ারপাড়ায় প্রচার ভবনের জন্য জমি অধিগ্রহণ করে এবং ১৯৮৫ সালের ১৪ এপ্রিল উদ্বোধন হয় বাংলাদেশ বেতার, রংপুরের প্রচার ভবন এর। নতুন ভবনে কলেবর বৃদ্ধি হয় অনুষ্ঠানের। উল্লেখ্য, ১৯৬৭ সালের রংপুর বেতার উদ্ধোধন হলেও এর প্রায় তিন বছর পর অর্থাৎ মুক্তিযুদ্ধের মাত্র তিন মাস আগে ১৯৭০ এর ১১ ডিসেম্বর এ কেন্দ্র থেকে প্রথম স্থানীয় সংবাদ প্রচার শুরু হয়। রংপুর অঞ্চলে বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর মানুষ ছাড়াও ওরাও, সাঁওতাল, মুন্ডা, মাল এমনি নানা সম্প্রদায়ের আদিবাসীর বাস। এদের রয়েছে নিজস্ব রীতি নীতি এবং সংস্কৃতি। এই আদিবাসী জনগোষ্ঠীকে বেতার অনুষ্ঠানে সম্পৃক্ত উদ্দেশ্যে ১৯৮১ সালে ১৪ এপ্রিল দিনাজপুরের হেমায়েত হলে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের আদিবাসীদের সমন্বয়ে এক আদিবাসী সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হয়। “মহুয়া” শিরোনামে এ অনুষ্ঠানটি সরাসরি মঞ্চ থেকে বেতারে প্রচার করা হয় এবং সেদিন থেকে বেতার অনুষ্ঠান পরিকল্পনায় “মহুয়া” সংযোজন। প্রথমে প্রতি মাসে একবার পরে ১৯৮৫ তে প্রচার ভবনে আসার পর মাসে দুবার এবং এর পর সাপ্তাহিক হিসাবে অন্তভূক্ত হয় যা অব্যাহত রয়েছে। এ কেন্দ্রের আরো উল্লেখযোগ্য অনুষ্ঠান সম্ভার, স্বাস্থ্য বিষয়ক ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান স্বাস্থ্য জিজ্ঞাসা ইত্যাদি। এ এম (মিডিয়াম ওয়েভ) সম্প্রচার ১০৫৩ কিঃ হাঃ/ ২৮৪.৯০ মিটার এবং এফএম ব্যান্ড ১০৫.৪, ৯০ ও ৮৮.৮ মেগাহার্জে বিবিসি ও রংপুর কেন্দ্রে অনুষ্ঠান সম্প্রচার করা হয। বিশ্ব যখন ক্রমেই ডিজিটাল হচ্ছে, তখন বাংলাদেশ বেতার, রংপুরেও তার ছোয়া লাগে একবিংশ শতকের শুরুতে। পুরনো এনালগ মেশিন, টেপ ফেলে দিয়ে কম্পিউটার নির্ভর রেকর্ডিং, এডিটিং এবং সম্প্রচার শুরু হয়। সবার হাতে হাতে মোবাইল ফোন চলে আসায় এফ এম রেডিও শোনানোর জন্য কেন্দ্রে তিনটি এফ এম (১০৫.৪, ৯০.০০ ও ৮৮.৮ মেগাহার্জ) ট্রান্সমিটার স্থাপিত হয়েছে। ভাওয়াইয়া গানের সংগ্রহশালা স¤ৃদ্ধ করার জন্য ২০০৮ এ প্রতিষ্ঠা করা হয় ’ভাওয়াইয়া আর্কাইভ’। বেতার অনুষ্ঠানে শ্রোতাদের সরাসরি অংশগ্রহণের জন্য ২০০৭ সালে চালু করা হয় স্বাস্থ্য, কৃষি, পড়াশোনা ও ধর্ম বিষয়ক ফোন-ইন অনুষ্ঠান। এছাড়াও ছাত্র-ছাত্রী ও শ্রোতাদের জ্ঞানের ভান্ডার বৃদ্ধির জন্য চালু করা হয় বিতর্ক, বিজ্ঞান ও কুইজ প্রতিযোগিতা। এছাড়াও বিভিন্ন বহিরাঙ্গন অনুষ্ঠানের পাশাপাশি এসময় কেন্দ্র প্রথমবারের মতো ১০৭টি বেতার শ্রোতাক্লাবের অংশগ্রহণে শ্রোতাক্লাব সম্মেলন করে ২০১১ সালে।